আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র “বাংলাদেশ” – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান



৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯.
সোহরাওয়ার্দী-শের-এ-বাংলার মাজার প্রাঙ্গণ, ঢাকা
স্বার্থবাদী মহল আসন্ন সাধারণ নির্বাচন বানচালের যে চক্রান্ত চালাচ্ছে, তা প্রতিহত করে ছয়-দফার স্বপক্ষে ঐক্যবদ্ধ রায় ঘোষণা করতে পারলে বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ঠেকিয়ে রাখিতে পারে এমন সাধ্য পৃথিবীতে কারো নেই। বাংলার এই কৃতী সন্তানের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে আজ আমরা আবার এই শপথই ঘোষণা করছি যে, আমরা সত্যিকারের নাগরিক হিসাবে বাঁচতে চাই- কারো গোলাম হয়ে থাকতে চাই না। গণ প্রতিনিধিদের দ্বারা স্বায়ত্তশাসন সহ সমুদয় জাতীয় সমস্যার সমাধানকল্পে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে কর্মসূচী ঘোষিত হয়েছে, নানা ছুতা-নাতা দেখিয়ে তা বানচাল করার জন্য স্বার্থবাদী মহল চক্রান্ত শুরু করেছে। এই চক্রান্ত রুখে দাঁড়ান। স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা প্রদান করা হলে ভালো হতো। তবে নির্বাচিত গণ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার উদ্দেশ্যেই নির্বাচন বানচালের চেষ্টা প্রতিহত করতে হবে। কোন কোন নেতা এক লোক এক ভোটের অর্থ বোঝেন না। এর একমাত্র অর্থ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব। এছাড়া অন্য কোন অর্থ বুঝতে হলে আমাদেরকে নতুন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে হবে।
বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক দাবির প্রশ্ন তুললেই চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং তার দোসররা আঁতকে ওঠেন। এই অপরাধে বাঙালিদের কমিউনিস্ট, হিন্দুস্থানের এজেন্ট, আমেরিকার দালাল হিসেবে অভিহিত হতে হয়েছে, শুধু তাই নয়, গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি করার দরুনই কায়েমী স্বার্থবাদীদের তল্পিবাহকরা শের-এ বাংলাকে অন্তরীণাবদ্ধ করেছে, শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। অথচ আমরা কোনোদিন পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঠকাতে চাই নাই- শুধু ইনসাফ আর ন্যায্য পাওনা চেয়েছি। গণ-দুশমনরা যা কিছু খুশি বলুক- দালালি যদি কারো করে থাকি, সে আমার দেশ ও দেশবাসীর।
যদি সেদিন- আজ যারা বড় বড় কথা বলে বাজিমাত করতে চায়, কথায় কথায় বাঙালির দুঃখে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে- বাংলার চরম দুর্দিনে সেইসব নেতাকে বাঙালিরা পাশে পাই নাই। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন যখন ছয় দফার দাবিতে সারা বাংলা জেগে উঠেছিলো, যখন আমরা জেলে- ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক স্বৈরাচারী শক্তির বুলেটের আঘাতে রক্তাক্ত হচ্ছিল, সেই সময় এইসব বিপ্লবী নেতার কেউবা ভয়ে ঘরে খিল আটকিয়েছে কেউ বা ছয় দফা আন্দোলনে বহিঃশক্তির গন্ধ আবিষ্কারে লিপ্ত হয়েছে। সেদিন যদি এইসব নেতা আন্দোলনকে আগিয়ে নিতেন, বহুপূর্বে আইয়ুবের পতন ঘটত – স্বায়ত্তশাসনও আদায় হতো। বেঈমানদের সমুচিত শিক্ষা দিন। অগণিত দেশপ্রেমিকের পাশাপাশি এই বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছে একশ্রেণীর স্বার্থলোভী বেইমান। এরাই ব্যক্তিগত লাভ লোভের বিনিময়ে বারবার বাংলা আর বাঙালির স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে। দেশব্যাপী প্রচন্ড গণ-অভ্যুত্থানের দিনে অগণিত ছাত্র শ্রমিক কৃষক জনতার রক্তপাতের মধ্যদিয়ে আইয়ুবের পতন যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে সেই মুহূর্তেও সেই রক্তের দাগ না শুকাতেই বেঈমানের দল মন্ত্রিত্বের জন্য আইয়ুবের দুয়ারে ধর্না দিয়েছে। আগামী সাধারণ নির্বাচনে এই পেশাদার বেঈমানদের এমন শিক্ষা দিন যেন বাংলার পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে বাঙালির সঙ্গে বেঈমানি করার ধৃষ্টতা আর কারো না হয়। জনগণের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে আমি জেল খেটেছি, জুলুম সহ্য করেছি, ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়েছি। কিন্তু ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক জনতা বুকের রক্ত আমাকে আবার তাদের মধ্যে ফিরিয়ে এনেছে। দেশবাসীর যে ভালোবাসা ও আশীর্বাদ আমি পেয়েছি তার চাইতে বড় কিছুই আমার পাওয়ার নাই। দেশবাসীর রক্তের ঋণ আমি শোধ করবই।
কোনো কোনো মহল বলে বেড়াচ্ছেন যে, মরহুম সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র সমর্থন করেছেন। স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা না থাকায় এই শাসনতন্ত্র পাস হওয়ার সময় পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করার আগে নেতা যে বক্তৃতা দিয়াছেন তা পড়লেই বুঝা যাবে যে, তিনি ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র সমর্থন করেন নাই। বাইশটি পরিবারের হতে রাষ্ট্রের সমুদয় সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে আর গ্রামবাংলা শ্মশানে পর্যবসিত হয়েছে। রোগ-ব্যাধিতে অনাহার-অর্ধাহারে ক্লিষ্ট গ্রামবাসীদের গায়ে মাংস নাই। পাঁচ বছর ধরে শিল্পপতিদের ট্যাক্স হলিডে দেওয়া হয়েছে অথচ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদের খাজনা মওকুফ করা হয় নাই। শ্রমিকরা শিল্প-কারখানার শেয়ার পায় নাই। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। গণতন্ত্রই ছিল মরহুম নেতার সারা জীবনের সাধনা। তিনি চেয়েছিলেন, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠিত হউক। সোহরাওয়ার্দী আজ নাই, তার অভিষ্ট গণতন্ত্র আজ দেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। যদি কুচক্রীদের অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সাধারন নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, যদি দেশের নিরন্ন নিপীড়িত জনগণের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা যায় তবে তাই হবে মরহুম নেতার প্রতি সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য।
এখন হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র “বাংলাদেশ”। একসময় এ দেশের বুক হতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজেয় পাওয়া যায় নাই। বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদিত গণনায়ক শহীদদের সোহরাওয়ার্দী ও শের-এ বাংলার অমার্জনীয় অবজ্ঞা প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলার এই দুই কৃতী সন্তান আজ অসহায়ের মত আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই দুই নেতার মাজারের পার্শে দাড়িয়ে জনগণের পক্ষ হতে আমি ঘোষণা করছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র “বাংলাদেশ”।
_সাফি
সূত্র: ইত্তেফাক, ৬ ডিসেম্বর ১৯৬৯

No comments

Theme images by enot-poloskun. Powered by Blogger.